রাজধানীর শ্যামবাজারসংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে ঢাকা-চাঁদপুর রুটের এমভি ময়ূর ২ লঞ্চটি ভুল চালানোর কারণে ধাক্কা লেগে এমএল মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবে মারা যায় ৩৪ জন যাত্রী। ময়ূর-২ লঞ্চের চালকদের অসতর্কতা ও অবহেলার কারণেই ঘটে এ দুর্ঘটনা। গত ২৯ জুন সকালে এ দুর্ঘটনার জন্য ময়ূর-২ লঞ্চের চালকদের দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুই তদন্ত কমিটি।
এ ছাড়া বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবির ঘটনায় একের পর এক গ্রেপ্তার হচ্ছেন ময়ূর-২’র মালিক-চালকরা। এ ঘটনায় আরও ২ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে নৌ পুলিশ। তারা হলেন ময়ূর-২ লঞ্চের ইঞ্জিন চালক শাকিল ও শিপন। আজ বুধবার সকালে সাড়ে ১০টায় রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরিদা পারভীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবির ঘটনায় এক নম্বর আসামি ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ ছোয়াদকে গ্রেপ্তার করে নৌ পুলিশ। গ্রেপ্তার এড়াতে পুলিশি অভিযানের সময় নিজের বাসার বাথরুমের ফলস ছাদে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। পরে অনেক খোঁজা-খুঁজির পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যা ঘটেছিল সেই দিন
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ জুন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এমএল মর্নিং বার্ড লঞ্চকে বেপরোয়া এবং অতর্কিতভাবে ধাক্কা দেয় এমভি ময়ূর-২। এর ফলে মর্নিংবার্ড ডুবে যায় এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। মর্নিং বার্ডের ৩৪ যাত্রী মারা যান এতে। উদ্ধারকারী সংস্থাগুলো ডুবন্ত লাশগুলো উদ্ধার করে রাজধানীর মিডফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সুরতহালসহ সমস্ত আইনগত প্রক্রিয়া শেষে স্বজনদের খুব দ্রুত সময়ে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়। স্বজনদের কান্নার রোল আর আহাজারিতে শ্যামবাজারের আকাশ ভারি হয়ে ওঠে।
মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটেছে
তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ জুন ময়ূর-২ বোগদাদিয়া ডক ইয়ার্ড থেকে যাত্রা শুরু করে লাল কুঠির দিকে। অপরদিকে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে প্রায় ৬০-৬৪ জন যাত্রীসহ সদরঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করে মর্নিংবার্ড। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার শ্যামবাজার বরাবর ফরাশগঞ্জ ঘাট সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে কালীগঞ্জের কাছে ময়ূর-২-এর ডান পাশে থাকা মর্নিং বার্ডকে বেগতিকভাবে সজোরে আঘাত করে। মর্নিংবার্ড সোজা চলছিল আর ময়ূর-২ বোগদাদিয়া ডক ইয়ার্ড থেকে অনেকটা আড়াআড়িভাবে বের হয়ে আসে এবং মর্নিংবার্ডের পেছনে আঘাত করে। এতে মর্নিং বার্ড আড়াআড়ি হয়ে ময়ূর-২ এর পেটের নিচে চলে যায়।
যেভাবে গ্রেপ্তার লঞ্চের মালিক
নৌ পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার খো. ফরিদুল ইসলাম জানান, এমভি ময়ূর-২ এর মালিক ও কর্মচারীরা দায়িত্বে অবহেলা ও বেপরোয়া আচরণের পাশাপাশি কোনো শত্রুতামূলক মনোভাব বা পরিকল্পিতভাবে এ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, তার নিবিড় তদন্তের প্রয়োজন আছে। ঘটনার পরে ৩০ জুন নৌ পুলিশ বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে। এরপর থেকে নৌ পুলিশ তৎপর হয় এজাহার নামীয় এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামিদের ধরার জন্য।
তিনি জানান, এরই ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার ভোররাত শেরে বাংলা নগর থানার সোবহানবাগ এলাকা থেকে এজাহার নামীয় এক নম্বর আসামি ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ ছোয়াদকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, লঞ্চের দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকেই পলাতক ছিলেন ছোয়াদ। সম্ভাব্য সকল জায়গা খুঁজেও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পরে নৌ পুলিশের গোয়েন্দা দল জানতে পারে যে, গতকাল বুধবার রাতে সোয়াদ সোবহান বাগের তল্লাবাগ এলাকায় অবস্থান করবেন। এরপরই ওসি সদরঘাট, ঢাকা, নৌ পুলিশের দল ১০/৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে মধ্য রাতে অভিযান পরিচালনা করে।
আধ ঘণ্টা ধরে ইন্টারকমে ফোন করার পর একপর্যায়ে তার স্ত্রী কথা বলেন। তিনি জানান, বাসায় তিনি ছাড়া কেউ নেই। নৌ পুলিশ ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে গেট খোলার জন্য। এক ঘণ্টা পর দরজা খোলেন ছোয়াদের স্ত্রী। নৌ পুলিশ তল্লাশি করতে চাইলে তিনি জানান, সোয়াদ বাসায় নেই। পরে সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট তল্লাশি করে বাথরুমের ফলস ছাদ থেকে প্রায় খোলা শরীরে ছোয়াদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরিদা পারভীন জানান, নৌ পুলিশ আজ দুপুর ২টায় বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় এক নম্বর আসামিকে আদালতে সোপর্দ করে। জিজ্ঞাসাবাদের স্বার্থে ৭ দিনের পুলিশি হেফাজতের জন্য আবেদন করে নৌ পুলিশ। পরে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এই মামলার পলাতক অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান নৌ পুলিশের এ কর্মকর্তা।
Leave a Reply